গাজীপুর সাফারি পার্ক: বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল
গাজীপুর সাফারি পার্ক (Gaziantep Safari Park) শুধু একটি বিনোদন কেন্দ্র নয়, এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন মাওনা ইউনিয়নের বড় রাথুরা মৌজা ও সদর উপজেলার পীরুজালী ইউনিয়নের পীরুজালী মৌজার খন্ড খন্ড শাল বনের ৪৯০৯.০ একর বন ভূমি ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণির জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। এই বিশাল এলাকা জুড়েই গড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, যা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পর্যটন শিল্পের বিকাশে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
গাজীপুর সাফারি পার্কের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানার ধারণাকে ভেঙে দিয়ে সাফারি পার্কের ধারণাটি বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাণীদের তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধ বিচরণ করতে দেওয়া এবং দর্শকদের জন্য বন্যপ্রাণীদের জীবনযাত্রা কাছ থেকে উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করা। গাজীপুর সাফারি পার্কও এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সাফারি পার্ক প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ: বিপন্ন ও দুর্লভ প্রজাতির প্রাণীদের বংশবৃদ্ধি এবং সংরক্ষণে সহায়তা করা।
- গবেষণা ও শিক্ষা: বন্যপ্রাণী এবং পরিবেশ সম্পর্কে গবেষণা ও শিক্ষামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- পর্যটন বিকাশ: প্রকৃতির কাছাকাছি এসে বন্যপ্রাণীদের দেখার সুযোগ তৈরি করে পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধন করা।
- স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন: স্থানীয় মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করা।
গাজীপুর সাফারি পার্কের আকর্ষণীয় দিকসমূহ
বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই পার্কে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী ও পাখির দেখা মেলে। পার্কটিকে মূলত পাঁচটি অংশে ভাগ করা হয়েছে:
১. কোর সাফারি: এটি পার্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক, চিতা, হাতি, জলহস্তী, জেব্রা, জিরাফ, হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে বিচরণ করে। বাসের মাধ্যমে এই এলাকা ভ্রমণ করা যায়, যা দর্শকদের জন্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
২. সাফারি কিংডম: এখানে নানা ধরনের পাখি, সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। ইমু, প্যারাপাখি, ম্যাকাও, লেইস উইং, ক্রাউন পিজিওনসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এখানে দেখা যায়।
৩. বায়ো ডাইভার্সিটি পার্ক: এই অংশে বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও লতানো গুল্ম রয়েছে, যা পার্কের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এটি উদ্ভিদ বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহী দর্শকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান।
৪. ওয়াইল্ডলাইফ ব্রিডিং সেন্টার: এটি মূলত বন্যপ্রাণীদের প্রজনন কেন্দ্র। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
৫. বিনোদন এলাকা ও শিশুপার্ক: এখানে শিশুদের জন্য বিভিন্ন রাইড ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও, পর্যটকদের জন্য রেস্টুরেন্ট ও বিশ্রামাগারও রয়েছে।
গাজীপুর সাফারি পার্ক পরিদর্শনের সময় যা মনে রাখতে হবে
গাজীপুর সাফারি পার্কে প্রবেশ এবং কোর সাফারিতে ভ্রমণের জন্য টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী, বাসে করে কোর সাফারিতে ভ্রমণ করতে হয় এবং বাসের ভিতরে থাকা অবস্থায় কোনো রকম হইচই করা বা জানালা দিয়ে হাত বের করা নিষেধ। এছাড়া, বন্যপ্রাণীদের খাবার দেওয়া বা উত্যক্ত করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
সাফারি পার্কের গুরুত্ব
গাজীপুর সাফারি পার্ক শুধু বিনোদনের উৎস নয়, এটি পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন স্থানীয় মানুষজনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে বন্যপ্রাণী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে। এছাড়া, এই পার্কটি শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
গাজীপুর সাফারি পার্ক (Gazipur Safari Park) বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী প্রেমীদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান। বন্যপ্রাণীদের অবাধ বিচরণ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য এই পার্কটি অবশ্যই ঘুরে আসা উচিত। একইসাথে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় এই পার্কের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ভবিষ্যতে এর কার্যক্রম আরও প্রসারিত হবে এবং এটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে, এমনটাই প্রত্যাশা।
গাজীপুর সাফারি পার্ক এর প্রাণীর তালিকা
গাজীপুর সাফারি পার্কে থাকা প্রাণীর তালিকা ও সংখ্যা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ প্রাণী প্রজনন, স্থানান্তরণ বা অন্যান্য কারণে সংখ্যায় পরিবর্তন আসে। তবে, সাধারণত যেসকল প্রাণী এই পার্কে দেখা যায় এবং তাদের আনুমানিক সংখ্যা নিচে দেওয়া হলো:
বিভাগ-১: আফ্রিকান সাফারি জোন
এই জোনে সাধারণত খোলা পরিবেশে বড় আকারের প্রাণীরা বিচরণ করে।
- সিংহ (Lion): ৫-১০টি
- হায়েনা (Hyena): ২-৪টি
- জেব্রা (Zebra): ১৫-২৫টি
- জিরাফ (Giraffe): ১০-২০টি
- চিতা বা চিতা বিড়াল (Cheetah/Leopard): ২-৪টি (অনেক সময় চিতা বাঘের মতো দেখতে অন্যান্য বিড়াল প্রজাতির প্রাণীও থাকে)
- কালো ভালুক (Black Bear): ২-৪টি
বিভাগ-২: কোর সাফারি জোন
এই জোনে গাড়ি বা বাসে করে প্রবেশ করে প্রাণী দেখা যায়।
- বাঘ (Tiger): ৫-১০টি (সাধারণত বেঙ্গল টাইগার)
- সাদা সিংহ (White Lion): ১-২টি (যদি থাকে, এটি খুবই বিরল)
- কালো ভালুক (Black Bear): ২-৪টি
বিভাগ-৩: ফেন্সিং ও এনক্লোজার এরিয়া (নির্দিষ্ট খাঁচায় বা ঘেরা জায়গায় রাখা প্রাণী)
- হাতি (Elephant): ৪-৬টি
- মায়া হরিণ (Barking Deer): ৩০-৫০+ টি
- চিত্রা হরিণ (Spotted Deer): ১০০-১৫০+ টি
- সাম্বার হরিণ (Sambar Deer): ৫-১০টি
- নীলগাই (Bluebull/Nilgai): ২-৪টি
- অ্যাসিয়ান ব্ল্যাক বিয়ার (Asiatic Black Bear): ২-৪টি
- কুমির (Crocodile): ৫-১০টি
- ঘড়িয়াল (Gharial): ২-৪টি
- জলহস্তি (Hippopotamus): ২-৪টি
- কালো ভালুক (Black Bear): ২-৪টি
- উটপাখি (Ostrich): ১০-২০টি
- এমু পাখি (Emu): ৫-১০টি
- ওয়াল্ল্যাবাই (Wallaby): ২-৪টি (ক্যাঙ্গারুর ছোট সংস্করণ)
- কাকাতুয়া (Cockatoo): বিভিন্ন প্রজাতির, সংখ্যায় ১০-২০+ টি
- ম্যাকাও (Macaw): বিভিন্ন প্রজাতির, সংখ্যায় ১০-২০+ টি
- লাভবার্ড (Lovebirds): ৫০-১০০+ টি
- বাজরিগার (Budgerigar): ৫০-১০০+ টি
- বনমোরগ (Jungle Fowl): ১৫-৩০+ টি
- ময়ূর (Peacock): ২০-৩০+ টি
- বিভিন্ন প্রজাতির সাপ (Various Snakes): যেমন – অজগর, কোবরা ইত্যাদি, সংখ্যায় ২০-৩০+ টি
- বিভিন্ন প্রজাতির বানর ও হনুমান (Monkeys & Langurs): ৫০-১০০+ টি
- গুইসাপ (Monitor Lizard): ১০-২০+ টি
- শকুন (Vulture): ২-৪টি (বিরল প্রজাতি, সংরক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও থাকতে পারে)
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই তালিকাটি আনুমানিক এবং এটি সর্বশেষ তথ্য নাও হতে পারে। সাফারি পার্কের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত প্রাণীর সংখ্যা ও প্রজাতি হালনাগাদ করে থাকে। পার্ক পরিদর্শনের আগে তাদের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট বা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে হালনাগাদ তথ্য জেনে নেওয়া ভালো।
কীভাবে ঘুরতে যাবেন?
- কীভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে অথবা ট্রেনে করে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত এসে, সেখান থেকে স্থানীয় সিএনজি বা অটো রিকশায় করে Safari Park-এর সামনে বা মাওনা/পীরুজালী এলাকার দিকে যাওয়া যায়। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়েও সহজে যাতায়াত করা সম্ভব।
- টিকিট ও খরচ: Safari Park-এর প্রবেশ মূল্য সাধারণত জনপ্রতি ৫০-১০০ টাকা (প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য) এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ১০-৫০ টাকা। Safari Park-এর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন রাইড বা স্থান পরিদর্শনের জন্য আলাদা টিকিট লাগে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনের ভেতর ট্রেকিং-এর ব্যবস্থা করা গেলে আলাদা খরচ হতে পারে। Safari Park-এর বাইরে নিজস্ব উদ্যোগে ঘুরতে গেলে কোনো প্রবেশ মূল্য নেই।
- খাবার ও অফার: Safari Park-এর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট রয়েছে, যেখানে নানা ধরনের দেশীয় খাবার, ফাস্ট ফুড, পানীয় ইত্যাদি পাওয়া যায়। এছাড়া, বাইরে স্থানীয় কিছু দোকানে খাবার পাওয়া যায়। ভ্রমণের সময়, বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বা উৎসবের সময়, বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুর বা অফার পাওয়া যেতে পারে।
- অফিশিয়াল সাইট এ দেখুন