ঈদে মিলাদুন্নবী: তাৎপর্য, ইতিহাস ও বাংলাদেশে সরকারি ছুটি
আগামীকাল ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, বাংলাদেশে পালিত হবে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। আরবি ১২ রবিউল আওয়াল এর এই দিনটি মানবজাতির জন্য মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবস হিসেবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও ইসলামি ইতিহাসবিদদের মতে এই রবিউল আওয়ালের কোন এক সোমবার মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহন করেন কিন্তু তারিখ অনিশ্চিত। এর কারণ ওই সময় আরব জগতে তারিখের হিসাব রাখা হত না। যা শুরু হয় রসুলের মৃত্যুর প্রায় ৫-১০ বছর পর। ইরাক, ইরান সহ ভারতীয় উপমহাদেশে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সাথে পালন করা হয়। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে দিনটি পালনের জন্য বাংলাদেশ সরকার আগামীকাল ৫ সেপ্টেম্বর সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে এ উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকবে।
ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রেক্ষাপট
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) শুধু একটি উৎসব নয়, এটি মহানবীর (সা.) জীবনের শিক্ষা ও আদর্শকে স্মরণ করার দিন। এই দিনে মুসলিম সম্প্রদায় মহানবীর (সা.) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে, তাঁর দেখানো পথে চলার প্রতিজ্ঞা করে এবং দরিদ্রদের মাঝে দান-খয়রাত করে।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালনের সূচনা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। কারো মতে, মিশরের ফাতেমীয় শাসকরা সর্বপ্রথম এই দিনটি উদযাপন করা শুরু করেন। আবার কারো মতে, দ্বাদশ শতাব্দীতে ইরাকের মুজাফফর উদ্দিন কুকুবুরী প্রথম জাঁকজমকের সাথে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করেন। তবে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটাই—মহানবীর (সা.) প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো।
ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস
ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর উদযাপন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। প্রথম দিকে এটি ব্যক্তিগত বা ঘরোয়াভাবে পালিত হতো। ধীরে ধীরে এটি বৃহত্তর পরিসরে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হয়। এই দিনে মসজিদ, মাদরাসা ও বিভিন্ন ইসলামিক প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়।
ইসলামের অনেক মনীষী এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে অনেক আলোচনা করেছেন। তাঁদের মতে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি মহানবীর (সা.) আদর্শকে জীবনে প্রতিফলিত করার একটি সুযোগ। এই দিনে আমরা তাঁর দয়া, ক্ষমা, মহানুভবতা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করি এবং নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি।
ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে প্রচলিত কিছু বিতর্ক নিচে সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
- উদযাপনের বৈধতা: কিছু মুসলিম পণ্ডিত মনে করেন, এটি ইসলামের প্রথম যুগে পালিত হয়নি এবং এটি একটি ‘বিদআত’ (ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নয় এমন নতুন প্রথা)।
- নির্দিষ্ট তারিখ: মহানবী (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের সঠিক তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তাই এই দিনটি উদযাপনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
- আনুষ্ঠানিকতা: এই দিনে অনুষ্ঠিত শোভাযাত্রা, বিশেষ আয়োজন ও অনুষ্ঠানগুলো শরিয়তসম্মত কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
- ধর্মীয় বিভাজন: এই দিবস পালন করা হবে কি হবে না, এ নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ফেরকা বা গোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্নমত দেখা যায়।
- ইতিহাসে অনুপস্থিতি: অনেক সমালোচক যুক্তি দেন যে ইসলামের প্রথম দিকের কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাসে এই দিনটি পালনের কোনো প্রমাণ নেই।
বাংলাদেশের সংবাদে ঈদে মিলাদুন্নবী
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে থাকে। জাতীয় পত্রিকাগুলো বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে ইসলামিক আলোচনা, হামদ, নাত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ বেতারও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে।
এ বছরও এর ব্যতিক্রম নয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইসলামিক স্কলার ও বিশেষজ্ঞরা মহানবীর (সা.) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। পাশাপাশি, সরকারি ছুটি ঘোষণা ও অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
দিনটির তাৎপর্য
ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিনে আমরা মহানবীর (সা.) জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি এবং নিজেদের জীবনকে তাঁর আদর্শের আলোকে আলোকিত করার চেষ্টা করি। এটি আমাদের মধ্যে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় করে।
এই বিশেষ দিনে, আমাদের সকলের উচিত মহানবীর (সা.) শিক্ষা ও আদর্শকে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করা। তাঁর দেখানো পথে চলে একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে অবদান রাখা।
পরিশেষে, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। এই দিনে মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে মহানবীর (সা.) আদর্শ অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।