জাকসু নির্বাচন, অর্থাৎ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন, আজ এক ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। সকলের মনে একটাই আশা, এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আরও উন্নত হবে।
দীর্ঘ বিরতির পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর গুরুত্ব অনেক। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। ক্যাম্পাসে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে, বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা দিনরাত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান: জাকসু নির্বাচনের প্রেক্ষাপট
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে। এরপর নানা কারণে নির্বাচনটি আর অনুষ্ঠিত হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ছাত্রসংগঠনগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও সফল হতে পারেনি। অবশেষে সকল জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।
শিক্ষার্থীরা মনে করেন, নিয়মিত জাকসু নির্বাচন হওয়া উচিত। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যাগুলো সরাসরি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় এবং দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়। একটি কার্যকর ছাত্র সংসদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ উন্নত করতে, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা করতে এবং ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্যানেলসমূহ
এবারের নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক মিলিয়ে মোট ৮টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রসংগঠন। তাদের পরিচয় এবং লক্ষ্য সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো:
ছাত্রদল সমর্থিত পূর্ণাঙ্গ প্যানেল: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এই নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিয়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে এবং ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’: ইসলামী ছাত্রশিবির ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ নামে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তারা ক্যাম্পাসে ইসলামী মূল্যবোধের প্রচার এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক মান উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে।
বাগছাসের ‘সম্মিলিত ঐক্য ফোরাম’: বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন (বাগছাস) ‘সম্মিলিত ঐক্য ফোরাম’ নামে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তারা শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে চায়।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশের পৃথক প্যানেল ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ ও ‘সংশপ্তক পর্ষদ’: বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের দুটি অংশ ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ ও ‘সংশপ্তক পর্ষদ’ নামে দুটি পৃথক প্যানেল দিয়েছে। তারা উভয়েই ক্যাম্পাসে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির ধারা বজায় রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
স্বতন্ত্র প্যানেলসমূহ: এছাড়া আরও তিনটি স্বতন্ত্র প্যানেল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্যানেলগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব দিয়ে গঠিত। তারা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে নতুন চিন্তা নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী।
নির্বাচন প্রক্রিয়া ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
জাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। ভোটগ্রহণের জন্য প্রতিটি হলে আলাদা বুথ স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া, নির্বাচন কমিশন সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছে।
শিক্ষার্থীরা যেন নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পরিচয়পত্র দেখিয়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাদের নিজ নিজ বুথে ভোট দিতে পারবেন। ভোট গণনা শেষে দ্রুত ফলাফল ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও ভবিষ্যৎ
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন আশা জেগেছে। তারা মনে করেন, নির্বাচিত ছাত্র সংসদ তাদের সমস্যাগুলো সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা, শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসার – এসব বিষয়ে ছাত্র সংসদ কাজ করবে বলে শিক্ষার্থীরা আশা করেন।
জাকসু নির্বাচন শুধু একটি নির্বাচন নয়, এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের একটি প্ল্যাটফর্ম। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে অবদান রাখবে – এটাই সকলের প্রত্যাশা।
এই নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দিতে বদ্ধপরিকর। তারা প্রমাণ করতে চায়, গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে নেই। জাকসু নির্বাচনের এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে যাত্রা শুরু করলেও, স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে এর বর্তমান নামকরণ হয়।
প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে মাত্র একটি অনুষদ ও চারটি বিভাগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রয়েছে ৬টি অনুষদ, ৩৬টি বিভাগ, ৪টি ইনস্টিটিউট এবং ২১টি আবাসিক হল। এখানেই প্রথম চালু হয় দেশের নৃবিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, আর দেশের একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও এখানেই অবস্থিত।
শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নেও এগিয়ে যাচ্ছে জাবি। বর্তমানে নির্মাণাধীন বিশ্বমানের গ্রন্থাগারটি সম্পন্ন হলে এটি হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম লাইব্রেরি।
ছাত্রসংখ্যায় তুলনামূলকভাবে ছোট হলেও জাতীয় ও অভ্যন্তরীণ নানা আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা সবসময়ই ছিল অনস্বীকার্য। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক আন্দোলনের মিলনস্থল হিসেবে এই ক্যাম্পাস আজও দেশের উচ্চশিক্ষার এক উজ্জ্বল প্রতীক।
সংশ্লিষ্ট সংবাদ
- রাত পোহালেই জাকসু নির্বাচন
- বহিরাগত ঠেকাতে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে ৫ গেট
- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ইউনিটে কত আসন?
- Jahangirnagar University Site