জমির দলিল নিয়ে কাজ করার সময় আমাদের অনেকেরই নানা ধরনের জটিলতায় পড়তে হয়। কারণ, দলিলের ভাষায় এমন কিছু শব্দ আর সংকেত ব্যবহার করা হয়, যা আমাদের কাছে পরিচিত নয়। সাফকবলা, হেবা, দানপত্র, বায়না দলিল, আমমোক্তারসহ অন্যান্য জমির দলিলে এই শব্দগুলো প্রায়ই দেখা যায়। এসব শব্দের অর্থ যদি সঠিকভাবে না জানা থাকে, তাহলে আইনি ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই, নিচে দলিলে ব্যবহৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ শব্দের অর্থ দেওয়া হলো, যা আপনাকে দলিল বুঝতে এবং যাচাই করতে সাহায্য করবে।
দলিলে ব্যবহৃত কিছু শব্দের অর্থ
১. গং
একজনের নামের পর ‘গং’ থাকলে বুঝতে হবে তার সাথে আরও কিছু মানুষ বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রয়েছে। এটি একটি দল বা গোষ্ঠীকে বোঝায়।
২. খং
এটি খতিয়ান শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ। খতিয়ানে জমির বিস্তারিত বিবরণ, যেমন দাগ নম্বর ও মালিকের অংশের হিসাব থাকে। এটি সরকারি জরিপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
৩. নিং
এর অর্থ নিরক্ষর। কোনো ব্যক্তি যদি স্বাক্ষর করতে না পারেন, তখন তার নামের আগে ‘নিং’ লেখা হয়। এরপর অন্য কেউ তার হয়ে স্বাক্ষর করে দেন।
৪. বং
এর অর্থ বাহক। যিনি নিরক্ষর ব্যক্তির হয়ে দলিলে স্বাক্ষর করেন, তার নামের আগে এই শব্দটি লেখা হয়।
৫. সাং
এটি সাকিন বা গ্রাম বোঝায়। কোনো ব্যক্তির বসবাসের ঠিকানা লেখার সময় এটি ব্যবহার করা হয়।
৬. জং
দলিলে কোনো বিবাহিত নারীর স্বামীর নাম লেখার সময় এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটি স্বামী শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ।
৭. মং
এর অর্থ মোট। এটি কোনো মোট পরিমাণ বা হিসেব বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। অনেক সময় এর বদলে ‘মবলক’ শব্দটিও ব্যবহার করা হয়।
৮. এওয়াজ
এর অর্থ বিনিময়। যখন কোনো ব্যক্তি সমমূল্যের জমি বা সম্পদ আরেকজনের সাথে বদল করেন, তখন সেই লেনদেনকে ‘এওয়াজ’ বলা হয়।
৯. সিট
এটি একটি মানচিত্রের অংশকে নির্দেশ করে।
১০. পিং
এর অর্থ পিতা। দলিলে কোনো ব্যক্তির বাবার নামের আগে এই শব্দটি লেখা হয়।
১১. ইয়াদিকৃত
এটি পুরনো দলিলগুলোতে দেখা যায় এবং এর অর্থ হলো ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে শুরু’।
১২. পত্র মিদং
এর অর্থ হলো ‘পত্রের মাধ্যমে’। কোনো কিছু চিঠি দিয়ে জানানো বা কাউকে অবগত করা হলে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়।
১৩. বিং
এর অর্থ বিস্তারিত। কোনো বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
১৪. দং
এর অর্থ দখলকারী। কোনো জমি যিনি বর্তমানে ভোগদখল করছেন, তার নামের পাশে এই শব্দটি লেখা হয়।
১৫. হাল দাগ
এর মানে হলো জমির বর্তমানে প্রচলিত দাগ নম্বর।
১৬. সাবেক দাগ
এর অর্থ পূর্বের বা আগের দাগ নম্বর।
১৭. চালা
এটি এমন এক ধরনের জমি, যা একটু উঁচু এবং যেখানে সহজে চাষ করা যায়।
১৮. নাল
যে জমি চাষের উপযোগী বা যেখানে চাষবাস করা হয়, তাকে ‘নাল’ বলা হয়।
১৯. বাইদ
এটি বৃষ্টির পানি জমে থাকে এমন নিচু ও জলাভূমি প্রকৃতির জমিকে বোঝায়।
২০. কোর্ফা বা কোরফা
এটি হলো জমির মালিকানা স্বত্ব, যা কোনো প্রজা তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা রাজার কাছ থেকে নিয়ে চাষ করতেন।
২১. ছাহাম
এটি জমিজমার অংশ বা ভাগ বোঝায়। বিশেষ করে শরিকদের মধ্যে প্রাপ্য অংশ বণ্টনের ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
২২. খাসজমি
এটি হলো সরকারি মালিকানাধীন জমি।
২৩. পতিত জমি
যে জমি একসময় চাষ করা হতো, কিন্তু জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য সাময়িকভাবে চাষাবাদ বন্ধ রাখা হয়েছে, তাকে ‘পতিত জমি’ বলা হয়।
২৪. চাকরান
জমিদাররা তাদের কর্মচারীদের বেতনের বদলে যে জমি ভোগদখলের সুবিধা দিতেন, তাকে ‘চাকরান’ বলা হতো।
২৫. ছুট বা ছুটা দাগ
জমির নকশা তৈরির সময় যদি কোনো দাগ নম্বর ভুলবশত বাদ পড়ে যায়, তাহলে সেই বাদ পড়া নম্বরটিকে ‘ছুট’ বা ‘ছুটা দাগ’ বলা হয়।
২৬. বাটা
এর অর্থ বিভক্ত। জমির নকশা করার সময় একটি দাগকে ভাগ করে নতুন দাগ নম্বর তৈরি করা হলে তাকে ‘বাটা দাগ’ বলা হয়।
২৭. ছড়া বা ছড়ি
পাহাড় বা টিলা থেকে সমতলের দিকে ছড়িয়ে আসা জমিকে এই নামে ডাকা হয়।
২৮. নয়নজুলি
রাস্তা তৈরির সময় দুই পাশ থেকে মাটি তোলার ফলে যে নালা বা গর্ত তৈরি হয়, তাকে ‘নয়নজুলি’ বলা হয়।
২৯. হালট
এটি হলো জমির পাশ দিয়ে চাষের সুবিধার জন্য তৈরি গবাদিপশু বা কৃষকদের চলাচলের পথ।
৩০. সিকস্তি
নদী বা সাগরের জোয়ারে যখন কোনো জমি ভেঙে যায় বা বিলীন হয়ে যায়, তখন তাকে ‘সিকস্তি’ বলে।
৩১. পয়স্তি
নদী বা সাগরে হারিয়ে যাওয়া কোনো জমি যখন আবার চর হয়ে ভেসে ওঠে, তাকে ‘পয়স্তি’ বলা হয়।
৩২. বিলা
এর অর্থ জলাবদ্ধ এলাকা বা মৌসুমি জলাভূমি।
৩৩. ডাঙ্গা
এটি চাষের উপযোগী উঁচু জমিকে বোঝায়।
৩৪. গোপাট
এটি হলো এমন পতিত জমি, যেখানে গবাদিপশু ঘাস খাওয়ার জন্য ঘুরে বেড়ায়।
৩৫. কোলা জমি
বসতবাড়ির সঙ্গে লাগোয়া চাষাবাদের উপযোগী জমিকে ‘কোলা জমি’ বলা হয়।
৩৬. চিরাগী
মসজিদ বা কবরস্থানে আলো জ্বালানোর খরচ মেটানোর জন্য দান করা ভূমিকে ‘চিরাগী’ বলা হয়।
৩৭. পালাম ভূমি
বসতবাড়ির পাশেই সবজি চাষের জন্য যে উঁচু জমি থাকে, তাকে ‘পালাম ভূমি’ বলা হয়।
৩৮. লায়েক জমি
এর অর্থ চাষের উপযুক্ত জমি।
৩৯. কস্য
এর অর্থ ‘কার নামে দলিল’। মালিকের নামে দলিল হলে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
৪০. মৌরশী
এটি হলো পৈত্রিক সম্পত্তি।
৪১. চটান
বাড়ির কাছে থাকা উঁচু কিন্তু সমতল বা ঢালু এলাকা, যেখানে কোনো চাষাবাদ হয় না, তাকে ‘চটান’ বলা হয়।
৪২. ইজা
কোনো চলমান হিসাবে পূর্বের হিসেব টেনে আনাকে ‘ইজা’ বলা হয়।
৪৩. খারাজ
কৃষিকাজের জমিতে যে কর বা খাজনা ধার্য করা হয়, তাকে ‘খারাজ’ বলা হয়।
৪৪. লাখেরাজ
এটি এমন জমি, যেখানে কোনো কর দিতে হয় না বা যা করের আওতামুক্ত।
৪৫. তসদিক
কোনো প্রমাণ, দলিল বা সাক্ষ্যের মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করাকে ‘তসদিক’ বলা হয়।
৪৬. জমাবন্দী
এটি হলো ভূমি অফিসে প্রজা বা ক্রেতার নাম, জমির বিবরণ ও খাজনার হিসেব লিপিবদ্ধ করা।
৪৭. আমলনামা
এটি জমিদারের পক্ষ থেকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার নির্দেশপত্র বা দলিল।
৪৮. চান্দিনা
হাটবাজারের জন্য স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেওয়া অকৃষি জমিকে ‘চান্দিনা’ বলা হয়।
৪৯. হারাহারি
এর অর্থ গড়পড়তা বা অনুপাত অনুযায়ী ভাগবাঁটোয়ারা। জমির পরিমাপ বা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়।
৫০. তৌজি
এটি ব্রিটিশ আমলে রাজস্ব আদায়ের জন্য ব্যবহৃত একটি রেকর্ড, যেখানে জমির রাজস্বের পরিমাণ ও মালিকের নাম লেখা থাকে।
৫১. কায়েমি
এর অর্থ এমন একটি বিশেষ অধিকার, যা স্থায়ী এবং সহজে বাতিল করা যায় না।
৫২. খাইখন্দক
এটি জলাশয় বা গর্তযুক্ত ভূমিকে বোঝায়।
৫৩. বাস্তু
এর অর্থ বসতভিটা।
৫৪. রোক
এর অর্থ নগদ। নগদ টাকায় কেনা জমিকে ‘রোক’ বলা হয়।
৫৫. আসলি
এটি মূল ভূমি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৫৬. তুদাবন্দী
এর অর্থ জমির সীমানা নির্ধারণ করা।
৫৭. দিয়ারা
নদীর পলি জমে গঠিত কোনো চরাঞ্চল বা জমিকে ‘দিয়ারা’ বলা হয়।
৫৮. কিত্তা
এটি ভূমিখণ্ডকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৫৯. কবুলিয়ত
এটি এক ধরনের স্বীকারোক্তি দলিল।
৬০. কান্দা
নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা উর্বর ও উঁচু জমিকে ‘কান্দা’ বলা হয়।
৬১. কিসমত
ভূমির অংশ বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
৬২. গির্ব
এর অর্থ বন্ধক। কোনো জমি বন্ধক রাখা হলে বা বন্ধকি জমি বোঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
৬৩. টেক
নদীর পলি জমে তৈরি হওয়া ভূমিকে ‘টেক’ বলা হয়।
৬৪. দরবস্ত
এর অর্থ সবকিছু।
৬৫. দিঘলি
এর অর্থ নির্দিষ্ট খাজনা প্রদানকারী।
৬৬. নক্সা ভাওড়ন বা নকশা ভাওড়ন
এই শব্দ দুটি বলতে আগের কোনো জরিপের মানচিত্রকে বোঝানো হয়।